বাংলাদেশে সেল ও জিন থেরাপী : চিকিতসায় নতুন দিগন্ত (ডাঃ এম. মুর্শেদ জামান মিঞা)

বাংলাদেশে সেল ও জিন থেরাপী : চিকিতসায় নতুন দিগন্ত (ডাঃ এম. মুর্শেদ জামান মিঞা)

দেশে সেল-জিন থেরাপি: ক্যান্সারসহ জটিল রোগের চিকিতসায় আশার আলো

দেশে সেল-জিন থেরাপি: ক্যান্সারসহ জটিল রোগের চিকিৎসায় আশার আলো

বিশ্ব চিকিতসাবিজ্ঞানে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো সেল থেরাপি, জিন থেরাপি এবং রিজেনারেটিভ মেডিসিন। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সার, রক্তরোগ, জিনগত অসুখ কিংবা অবক্ষয়জনিত রোগে ভুগতে থাকা মানুষদের জন্য এগুলো আশার আলো হয়ে উঠেছে।

প্রচলিত চিকিতসা অনেক ক্ষেত্রেই শুধু রোগ নিয়ন্ত্রণ করে, স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। অথচ CAR-T সেল থেরাপি (ক্যান্সারের জন্য), Gene Editing Therapy (থ্যালাসেমিয়া বা হিমোফিলিয়ার জন্য), কিংবা Stem Cell Therapy (হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা স্নায়বিক রোগের জন্য) রোগ নিরাময়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে সক্ষম হচ্ছে।

চীনের সাফল্য: অনুকরণীয় মডেল

সম্প্রতি চীনের ইনস্টিটিউট অব হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ডিজিজেস হাসপাতাল (আইএইচসিএএমএস) এবং হেইহে ল্যাবরেটরি অব সেল ইকোসিস্টেম (তিয়ানজিন) ঘুরে দেখা গেছে, তারা কীভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি, গবেষণা কেন্দ্র, আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং শিল্পখাতকে একত্র করে এক অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে।

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো—

২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চীন ১৯টি ইনভেস্টিগেশনাল নিউ ড্রাগ (আইএনডি) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন পেয়েছে।
২০২৩ সালে অনুমোদিত হয়েছে চীনের প্রথম CAR-T সেল থেরাপি পণ্য (CNCT19) লিউকেমিয়ার চিকিতসায়।
হিমোফিলিয়ার জন্য প্রথম জিন থেরাপি অনুমোদিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ১০০ জনের বেশি রোগী চিকিতসা পেয়েছেন।
β-থ্যালাসেমিয়ার জন্য CRISPR-Cas9 ভিত্তিক জিন এডিটিং থেরাপি-তে রোগীরা চার বছরের বেশি সময় ধরে ক্লিনিক্যাল রেমিশনে আছেন।
বর্তমানে তারা বছরে প্রায় ৩ লাখ রোগীকে রক্তরোগ সংক্রান্ত বিশেষায়িত চিকিতসা দিচ্ছে।

এমন একটি সমন্বিত ব্যবস্থা দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, গবেষণা ও শিল্প একসাথে এগোলে কীভাবে চিকিতসা খাতে বৈপ্লবিক অগ্রগতি সম্ভব।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, লিউকেমিয়া, মাইলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমের (MDS) মতো রক্তরোগ ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু এসব জটিল রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।

বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো হলো—

দেশে এখনো গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস (জিএমপি) ল্যাবরেটরি বা ক্লিনিক্যাল গ্রেড সেল কালচার সুবিধা নেই।
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত মলিকিউলার বায়োলজিস্ট, জেনেটিসিস্ট ও সেল থেরাপি বিশেষজ্ঞ চিকিতসক নেই।
জিন থেরাপি বা সেল থেরাপি পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি ও আইনগত কাঠামো অনুপস্থিত।
রোগীদের বিদেশে চিকিতসা নিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
সাধারণ মানুষ এসব আধুনিক চিকিতসা সম্পর্কে সচেতন নয়।

বাংলাদেশে করণীয়

বাংলাদেশও চাইলে আগামী ১০ বছরে ধাপে ধাপে সেল ও জিন থেরাপি চালু করতে পারে। এজন্য নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো নেওয়া জরুরি—

১. জাতীয় সেল ও জিন থেরাপি গবেষণা কেন্দ্র :

ঢাকা বা রাজশাহীতে সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর হেমাটোলজি অ্যান্ড জিন থেরাপি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এখানে থাকবে—
•       স্টেম সেল ব্যাঙ্ক
•       জিন এডিটিং রিসার্চ ইউনিট
•       ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেসিলিটি
•       ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট

২. গবেষণা ও উতপাদন সুবিধা (GMP Facility) :

ক. প্রথম ধাপে Mesenchymal Stem Cell (MSC) উতপাদন ল্যাব শুরু করা যেতে পারে।
খ. পরবর্তী ধাপে CAR-T Cell Production এবং Gene Editing (CRISPR-Cas9) সুবিধা চালু করা জরুরি।

৩. অগ্রাধিকার ভিত্তিক রোগসমূহ :

•       রক্তরোগ: লিউকেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া
•       অসংক্রামক রোগ: হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক
•       অবক্ষয়জনিত রোগ: পারকিনসনস ডিজিজ, আলঝেইমারস

৪. মানবসম্পদ উন্নয়ন :

ক. চিকিতসক, বিজ্ঞানী ও টেকনোলজিস্টদের জন্য ফেলোশিপ ও হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং শুরু করা।
খ. বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে MoU করে যৌথ গবেষণা চালানো।
গ. মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে Cell & Gene Therapy Specialization চালু করা।

৫. সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ :

সরকারি বাজেটের পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও প্রাইভেট ভেঞ্চার ক্যাপিটাল যুক্ত করা।
WHO, World Bank ও ADB-এর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।

৬. নীতি ও আইনগত কাঠামো :

National Cell and Gene Therapy Policy 2030 প্রণয়ন করতে হবে।
নৈতিক অনুমোদন, রোগীর সুরক্ষা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথক নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা জরুরি।

সম্ভাব্য সুফল

যদি এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়, তাহলে—

  • বাংলাদেশের থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া ও লিউকেমিয়ার রোগীরা দেশে উন্নত চিকিৎসা পাবেন।
  • রোগীদের বিদেশে চিকিতসার জন্য যেতে হবে না, অর্থ সাশ্রয় হবে।
  • বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় Cell and Gene Therapy Hub হয়ে উঠতে পারবে।
  • নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বায়োটেকনোলজি ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বিকাশ লাভ করবে।
  • স্বাস্থ্যব্যবস্থা হবে Precision Medicine এবং Personalized Therapy-ভিত্তিক।

উপসংহার

চীন দেখিয়ে দিয়েছে—রাষ্ট্রীয় নীতি, গবেষণা ও শিল্প একসাথে কাজ করলে Cell & Gene Therapy স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশও একই ধারা অনুসরণ করতে পারে।

আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে CAR-T Therapy, Gene Editing, Stem Cell Transplantation এবং Personalized Medicine চালু করা সম্পূর্ণ সম্ভব। এটি শুধু চিকিতসার নতুন দিগন্তই নয়, বরং দেশের জন্য স্বাস্থ্যখাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হবে।

এমইউ/

বিস্তারিত- নিচের লিংকে –

https://medivoicebd.com/article/33295?fbclid=IwQ0xDSwMZPFdleHRuA2FlbQIxMQABHuQB4CLPEz19cFjqVmM5xm8-ckh8yKuW6aq1UMCvzAXqwSLR48mGaZc3-piY_aem_-T4D6svr217Zlru2uwynmQ

বাংলাদেশে সেল ও জিন থেরাপি: চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত – Dhaka Protidin