থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্ত পরিসঞ্চালন

থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood Transfusion)

থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood Transfusion)

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রধান চিকিৎসা হল রক্ত পরিসঞ্চালন। একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে ২-৫ সপ্তাহের ব্যবধানে এক থেকে দুই ইউনিট রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়। তবে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের সঠিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরন হচ্ছে কিনা তা বিবেচনার বিষয়। একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর কখন ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হবে, কি পরিমাণ ব্লাড ট্রান্সফিউশনের দরকার হবে, ব্লাড ট্রান্সফিউশন কোথায় নিরাপদ হবে, রক্তের সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে কি না, ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ফলে রোগীর হিমোগ্লোবিন স্তর এবং শারিরীক সুস্থতা কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সবকিছু পর্যবেক্ষন করতে হবে তবেই ব্লাড ট্রান্সফিউশনের সঠিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরন হবে।

ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত পরিসঞ্চালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ

থ্যালাসেমিয়া রক্ত পরিসঞ্চালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল একটি নিরাপদ এবং কার্‍্যকর ট্রান্সফিউশন রেজিমেন্স অর্থাৎ নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি প্রদান করা যেখানে দৈনন্দিন জীবনে ট্রান্সফিউশন থেরাপি বোঝা কমানো যায়।

o   সবাভাবিক/সঠিক বৃদ্ধি এবং রোগীর উন্নতি হওয়া।

o   রোগীর শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির স্তর উন্নত করা।

o   Extramedullary haematopoisis অর্থাৎ অস্থি মজ্জার বাইরের রক্ত কোষের গঠন পর্‍্যাপ্তভাবে না হওয়া।

নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন পরিচালনার শর্তগুলো হলঃ

o   যে পন্য/উপাদান অর্থাৎ রক্তের যে অংশটি ট্রান্সফিউশনের জন্য ব্যবহার করা হবে সেটি অবশ্যই সংগৃহীত, পরীক্ষিত, নির্বাচিত এবং নিয়ম বিধি এবং নির্দেশিকা দ্বারা গুনগত মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

o   প্রশিক্ষিত কর্মী দ্বারা ব্লাড ট্রান্সফিউশন কার্‍্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

o   রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে রোগীর ঙ্গান থাকা দরকার এবং রোগীকে সব বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন।

o   একটি প্রতিষ্ঠিত hemovigilance অর্থাৎ নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের পুরো সিস্টেম পরিচালিত হওয়া উচিৎ।

রক্ত দান (ব্লাড ডোনেশন):

থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদান করা উচিৎ। তাছাড়া ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত প্রিসঞ্চালনের পূর্বে রক্তের সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। EU, WHO, AABB এদের নির্দেশ মত সব দেশের রক্তের hepatitis B, C, HIV, Syphilis পরীক্ষা করা হয়। কিছু দেশ hepatitis E, A, HTLV i/ii, Malaria, Toxoplasma, West Nile virus, Chagas পরীক্ষা করে। তবে সব দেশে এই পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রক্তের সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা না হলে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ফলে অন্যান্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রক্তের উপাদানের নির্দিষ্ট বিবরনঃ

o   রক্ত সংগ্রহ করার পর ফ্রিজে সংরক্ষনের আগে ট্রান্সফিউশন (Pre-storage filtration blood transfusion) খুবই গুরুত্বপুর্ণ। এটি লিউকোসাইট হ্রাস করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়ায় লোহিত কনিকায় কম অবশিষ্ট লিউকোসাইট এবং লাল কোষ পুনরুদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ রক্ত সংগ্রহ করার পরে রক্ত প্যাকড রেড সেল (RCC) করে ব্লাড ব্যাঙ্কে সংরক্ষন করতে হবে। এই রক্তটি থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য খুবই কার্যকর হবে।

o   বেডসাইড ফিল্টারেশন হল প্যাকড রেড সেল ট্রান্সফিউশন চলাকালীন সময়ে ফিল্টার করা হয়। তবে এই পদ্ধতি সর্বোত্তম মান নিয়ন্ত্রণে কম গুরুত্বপুর্ন। কারণ এর কৌশল গুলো অত্যন্ত পরিবর্তনশীল হতে পারে।

বিশেষ রোগীদের জন্য রক্তের বিশেষ উপাদান ব্যবহারঃ

ওয়াশ রেড সেল(washed red cell): ওয়াশ রেড সেল সেই সব রোগীর জন্য উপকারি যাদের ঘন ঘন ব্লাড ট্রান্সফিউশন নেয়ার ফলে এলার্জি প্রতিক্রিয়া(alargic reaction) এর তীব্রতা বেশি হয় এবং যাদের IgA এর অভাব রয়েছে। রক্তদাতার রক্ত থেকে প্লাজমা প্রটিন কে wash করে রগীর শরীরে প্ররন করা হয়। এই পদ্ধতি হতে অর্থাৎ ম্যানুয়ালি বা মেশিনে অটোমেটিক্যালি করা হয়। ওয়াশ রেড সেল প্রস্তুত করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে রোগীকে পরিসঞ্চালন করতে হবে। এই জন্য ও্য়াশ রেড সেল তখনই প্রস্তুত করতে হবে তখন ওয়াশ রেড সেল দেওয়ার রোগী উপস্থিত থাকবে। ওয়াশ রেড সেল প্রস্তুত করার সময় লিউকোসাইট হ্রাস করার যে পদ্ধতি তাতে কিছু লোহিতকনিকা(erythrocyte) অপসারিত হয়। তাই যে সমস্ত রোগীকে ওয়াশ রেড সেল দেওয়া হয় তাদের পোস্ট ট্রান্সফিউশন হিমোগ্লোবিন এর স্তর লক্ষ্য পূরন হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষন করতে হবে।

উপযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষা(compatibility testing):

o   রক্ত পরিসঞ্চালন (transfusion theraphy) শুরু করার আগে রোগীর বর্ধিত red cell antigen typing করা উচিৎ যেখানে কমপক্ষে A, B, C, c, D, E, e kell অন্তভুক্ত এবং জিনোটাইপ/ফিনোটাইপ করা উচিৎ।

o   যদি রোগী এর মধ্যে blood transfusion হয়ে থাকে তবে antigen type serological পরীক্ষার পরিবর্তে molecular বা আণবিক পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

o   সকল থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ABO Rh(C, c, D, E, e) এবং kell, donor unit blood for ABO C, c, E, e, kell antigen একান্ত প্রয়োজন।

o   ব্লাড ট্রান্সফিউশন পরিচালনার আগে একটা সঠিক গ্রুপ এবং একটি antibody screening করা উচিৎ।

o   সকল রোগীর জন্য antigen typing, বর্তমান এবং আগের red cell antibody, blood transfusion হার, blood transfusion reaction হার এর সকল রেকর্ড রাখতে হবে। রোগী যদি কখনো অন্য কোন কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয় তবে এই রেকর্ড সেই কেন্দ্রে আগে জেনে নিতে হবে।

ট্রান্সফিউশন থেরাপি শুরু করার আগে বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণঃ

o   থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্নয় নিশ্চিত হওয়া।

o   হিমোগ্লোবিন স্তর ২ সপ্তাহের ব্যবধানে যদি ৭ গ্রাম/ডে.সি লিটার হয়।

o   ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট-রক্ত স্বল্পতার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষন গুলো উপস্থিত।

o   অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অথবা বৃদ্ধি ব্যহত হওয়া।

রক্ত পরিসঞ্চালন সময়সীমাঃ

রক্ত পরিসঞ্চালন এর উপর নির্ভরশীল রোগীদের সারাজীবন রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক থ্যালাসেমিয়া রোগীকে ২-৫ সপ্তাহের ব্যবধানে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বে হিমোগ্লোবিন স্তর পর্‍্যবেক্ষন করতে হিমোগ্লোবিন স্তর ৯.৫-১০.৫ গ্রাম/ডে.সি লিটার হলে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে এই সব রোগীদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, শারিরীক সক্ষমতা যেন ঠিকমত হয় সেই লক্ষ্য পূরন করতে হবে। কিছি কিছু রোগীর রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বের হিমোগ্লোবিন স্তর ১১.০-১২.০ গ্রাম/ডে.সি লিটার রাখা প্রয়োজন। যাদের হার্টের জটিলতা রয়েছে, clinically significant extramedullary haematopoise ও অন্যান্য অবস্থা খারাপ তাদের জন্য এটি প্রযোজ্য। মাঝে মাঝে কিছু রোগীর পিঠের দিকে ব্যাথা অনুভব করে। এ সব রোগীর জন্যও হিমোগ্লোবিন স্তর ১১.০-১২.০ গ্রাম/ডে.সি লিটার রাখা প্রয়োজন।

রক্ত পরিসঞ্চালন এবং প্লীহাঃ

থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে splenectomy রোগীর থেকে unsplenectomy রোগীর রক্ত নেয়ার প্রবনতা বেশি। এতে আয়রন লোডিং এর পরিমাণ ও বেশি হয়। unsplenectomy রোগীর ৩০% ট্রান্সফিউশন বেশি হয়ে থাকে। আধুনিক আয়রন চিলেশন যদি আয়রন লোডিং কমাতে সাহায্য করে তবে এটি নিয়মিত করা উচিৎ। আর যদি তা না হয় এবং বছরে 200 ml/kg রক্ত প্রিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয় তবে রোগীর splenectomy করার বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

Reference: The TIF Guidelines for the Management of Transfusion Dependent Thalassaemia (TDT), 4th edition, Version 2.0,

অনুবাদ সহযোগীতায়ঃ মোছাঃ শামীমা সারমিন মিমি।

(https://www.facebook.com/shamimasharmin.memi.1?mibextid=ZbWKwL)